লালন সাঁই গাঁজা নামক ‘মাদক’ বা অন্য কোন মাদকদ্রব্য সেবন করতেন না। তবে তার কোন কোন শিষ্য করতেন।
আচ্ছা, লালন যদি সেটা না করেন তাহলে তার শিষ্য কেনো করতেন?
বাউল মতে তো গুরুর মতো করে চলতে হয়। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্ন চলে আসে যে এর কারণ কী। এখানে এসে একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
আসছি সে কথায় তবে আগে বলি- নিখিল বঙ্গাঞ্চলের ইতিহাসে বাউল, জমিদার, চৌকিদার, অফিসার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি বহু রকমের মানুষই গাঁজা সেবন করেন/করতেন।
তবে বাউল- বিশেষ করে লালন ভক্তদের প্রতি গাঁজাসেবী তকমা দেবার একটা প্রবণতা গত ২০/২২ বছরে প্রচন্ড ভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি মনে করি এটা গাঁজা ও বাউল উভয়ের প্রতিই অবিচারের সামিল।
ভূমিকা দীর্ঘ না করে ব্যাখ্যায় যাই- কেনো ব্যক্তি লালন সাঁই গাঁজা না সেবন করলেও তার শিষ্যরা করেন এবং এ দুয়ের সম্পর্ক কী!
দেখুন ছবির মাধ্যমে তুলে ধরছেনঃ একজন কবির কাব্যচিত্র
তা বিষয় হলো দুটি, এক- দেহতাত্ত্বিক গুরুমুখী চর্চা, দুই- অপরের সক্ষমতাকে সম্মান।
বিষয় দুটি ব্যাখ্যার আগে অন্য একটি বিষয় বলে নেয়া দরকার, যেটা এই গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। তা হলো- চুল, দাঁড়ি, গোঁফ।
আমরা কি লক্ষ্য করেছি যে একই লালনের শিষ্য সবাই, কিন্তু কোন সাধুর চুল বড়, কোন সাধুর ছোট, কারো গোঁফ আছে, কারো নাই, কারো দাঁড়ি আছে বড়, কারো মাঝারি আর কারো নাই?
কারণ হলো- বাউল ফকির চর্চা এমন চর্চা যেখানে গুরু রূপে রূপ ধারণ করতে হয়। যার গুরুর চুল বড় সেই শিষ্যও চুল বড় রাখে। গুরুর দাঁড়ি থাকলে শিষ্যও দাঁড়ি রাখে সেই কারণে। যার গুরু মাছ খায়না তার শিষ্যও মাছ খায়না। যার গুরু গাঁজার সেবা নেয় তার শিষ্যও গাঁজার সেবা নেয়।
উদাহরণ দিলে- খোদাবক্স শাহ্ এর গোঁফ ছিলো- তার ভক্ত বজলু ফকিরের গোঁফ আছে, গুরু সালাম ফকির গাঁজা খান না- ভক্ত রুস্তম ফকিরও তাই খান না। টুনটুন ফকিরের গুরু নহীর ফকির মাছ খাননা- টুনটুন ফকিরও খাননা। দুর্লভ সাঁই’র যেরকম চুল- দাঁড়ি ছিলো তেমনি চুল- দাঁড়ি তার ভক্ত কলিমুদ্দিন ফকিরেরও।
এক নম্বর বিষয় তো বললাম, গুরুমুখী বিদ্যা, গুরু রূপে রূপ ধারণ। এবার প্রশ্ন চলে আসে- সবার গুরুই তো লালন, তাহলে তো সবারই লালনের মতো চুল, দাঁড়ি, মাছ, গাঁজা সব কিছু এক হিসেবে মেইনটেইন করার কথা। তা তো হলোনা, কেনো? একই লালনের শিষ্য হলে কেনো তাহলে শিষ্যদের অনুশীলন আলাদা?
লালন মেলাই মোবাইল সিম ব্যবসায়ীদের স্পন্সরের কারণে ২০০০ সালের পর থেকে লালনের নাম বেশী জানে তাই উদাহরণে লালনের কথাই বার বার বলছি।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বাংলার বাউল- ফকির এর ঘরানা পাঁচটি, লালন সাঁই, পান্জু শাহ, উজল চৌধুরী, দেলবার শাহ ও সতী মা। সেখানে কারো চেয়ে কারো গুরুত্ব কম নয়।
কুষ্টিয়া থেকে ট্রেনের সময়সূচী
যাই হোক- এবার আসে হলো দ্বিতীয় বিষয়, অপরকে সম্মান। লালন সাঁই তার কোন কোন শিষ্যকে অত্যন্ত সম্মান করতেন, যেমন তার পালক পিতা ও প্রথম শিষ্য মলম শাহ্, পন্ডিত মনিরুদ্দিন শাহ্, মা মতিজান, লালনের জীবনসঙ্গী বিশাখা ফকিরানি প্রমুখ।
লালনের কাছে যারা আসতেন তারা নানা ভাবে লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন। কেউ ভালোবেসে, কেউ বাহাস বা বিতর্ক করতে এসে, কেউ খোঁজ পেয়ে নানা জন নানা ভাবে শিষ্য হতেন। তাদের বয়স, শিক্ষা, ব্যাবহার, মেধা, আচরণ সবই ছিলো ভিন্ন ভিন্ন। তাদের কেউ কেউ ছিলেন বয়স্ক, কেউ কেউ ছিলেন খুব মেধাবী। তারা নিজেরা জানতেন যে কেনো তার চুল বড় বা ছোট, কেনো তিনি গাঁজা খান কিংবা খান না।
শিষ্যদের মধ্যে যাদের যাদের যুক্তি ও আচরণ লালনের পছন্দের ছিলো তাদেরকে তিনি গুরু হিসেবে স্বাধীনতা দিয়েছেন গাঁজা খাওয়ার বা মাছ খাওয়ার বা চুল ছোট রাখার কিংবা চুল- দাঁড়ি না রেখে শুধু গোঁফ রাখার।
যারা বুঝদার ব্যাক্তি ছিলেন তারা লালনের কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন, অনেকে বয়সেও বড় ছিলেন। লালন সাঁই যুবক বয়সেই অনেক সংখ্যক বিভিন্ন বয়সী শিষ্য লাভ করেন। তারা ধ্যানে মনসংযোগ আনতে এবং কেউ দীর্ঘদিনের অভ্যাসে গাঁজা খেতেন। তারা গাঁজা খেয়ে কখনো অন্যের কোন ক্ষতি করেন নি। তাদের মনোসংযোগে গাঁজা সাহায্য করতো।
আর গাঁজা তো হাজার হাজার বছর ধরে মেডিটেশনে সহায়ক প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে গৃহিত। একটা কথা আছেনা? ছুরি দিয়ে সন্ত্রাসী খুন করে আর ডাক্তার অপারেশন করে। জিনিস কিন্তু একই, ব্যবহার ভিন্ন।
পাশাপাশি বাউল ধর্মে একটা কথা আছে, ‘রতি স্থির না হলে মতি স্থির হয়না‘ আর গাঁজা রতি (কাম রিপু) স্থির করতে সহায়ক প্রাকৃতিক উপাদান। আর সেই লালনের সময়কালে ১৭০০ সালের শেষদিক ও ১৮০০ সালের পরে গাঁজা তো আর আজকের মতো ঘৃণিতও ছিলোনা, নিষিদ্ধ তো হলো সেদিন – ১৯৮০ সালেরও পরে।
একটা কথা বুঝতে হবে যে সেসময় কিন্তু সেখানে প্যাকেটজাত সিগারেট ছিলেনা। যারা মানুষ হিসেবে কাজে, কর্মে, আচরণে লালনের কাছে প্রিয় ছিলেন তাদেরকেই সেই অনুমতি লালন দিয়েছেন।
কিন্তু যারা গাঁজা খেয়ে গিয়ে অন্যের কোন ক্ষতি করতো বা নেশা করাটা মূখ্য ছিলো তাদের অনুমতি দিতেন না। কারণ তাদের ধ্যান বা মনোস্থির এর চেয়েও গাঁজার দমের নেশা টা মুখ্য ছিলো। লালন সাঁই নিজেই তো বলেছেন – “গাঁজায় দম চড়িয়ে মনা ব্যোম কালী আর বলিস নারে“। যাদের যুক্তি লালনের পছন্দ হয়নী তাদের সেসব অনুমতিও দেননি।
এখন লালনের মৃত্যুর প্রায় ১৩২ বছর পার হয়ে ১৩৩ এ এসে সেই শিষ্যদের শিষ্য সংখ্যা তো বেড়েছে। তারা তাই কেউ গাঁজা খাচ্ছে আর কেউ খাচ্ছে না। যার গুরু সেবন করছেন সেই শিষ্যও সেবন করছেন।
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় ঠিক যেই কারণে লালনপন্থীদের কেউ চুল বড় রাখেন আবার কেউ ছোট, কেউ মাছ খান আবার কেউ খান না সেই একই কারণে কেউ গাঁজার সেবা নেন আর কেউ নেন না। তবে লালন গাঁজার সেবা নিতেন বলে কখনো কোন সাধুর কাছে শুনিনি, তিনি নিতেন না বলেই আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্বাস।
সাথে আরেকটা কথা না বললেই নয়, ‘লালন মেলা’ হলে যে গাঁজার আখড়া বসে বলে আমরা জানি- তার সাথে মাদক সিন্ডিকেটের সাথে বা লাখো লাখো নেশাখোরের সম্পর্ক থাকতে পারে কিন্তু লালনের সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক নেই। আদতে- এই ‘লালন মেলা’ নামক একবিংশ শতকের মাল/বস্তু/ব্যাপারের সাথেই লালন এর কোন সম্পর্ক নেই, তিনি কোন মেলা টেলা করেননি, করতে বলেনও নাই। আর সেখানে ০.৫% ও লালন ভক্ত যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে।
সর্বশেষ ১৯৮২ সালে সহস্র বাউলকে মেরে ও দুর্লভ শাহ্ কে মেরে তার কাছ থেকে লালনের ঘরের সিন্দুকের চাবি কেড়ে নিয়ে তাদের চুল কেটে বিতাড়িত করে দেয়া হয়। উল্লেখ্য যে তৎকালীন সরকারই গাঁজাকে এদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত করে মার্কেট আউট করে দেয়, ফলশ্রুতিতে সারাদেশ ভরে যায় ভয়ংকর মাদক ফেন্সিডিল ও হেরোইনে। আর গাঁজা খাওয়ার দোষটা দেয়া হলো সেই লালন অনুসারীদেরকেই! এ এক প্রহসন।
সেকথা দুর্লভ শাহ্ আমাকে বলেছেন, আমি তাকে জীবিত পেয়েছিলাম। গাঁজা তো দূরের কথা আমি তাকে দেখেছি বৈধ কোম্পানীর গোল্ডলিফ সিগারেট খেতে, তখন তার বয়স ১২১ চলে প্রায়। ধার করা স্বল্প মেগাপিক্সেল সম্বলিত ক্যামেরায় সে ছবিও তুলে রেখেছি।

আমি: ১৯৮২ সালে যে আপনাদের মেরে চাবি কেঁড়ে নিয়েছিলো সে বিষয়ে বলেন।
দুর্লভ শাহ্: ও বাবা বহুত মারছিলো। ঐ মৌলবী আর সামসুর মিনিস্টার মিলে কি মার যে মারছিলো বাবা…
আমি: কেমন আহত হইছিলো?
দুর্লভ শাহ্: ঐদিন প্রায় ১৫০০ লোককে মারে, ১০ হাজার লোকের খাবার নষ্ট করে।
আমি: যারা আপনার কলার ধরে চাবি কেড়ে নিয়ে আপনাদেরই বের করে দিছিলো, তাদের কি আপনী ক্ষমা করতে পারছেন? (এ প্রশ্নটা এজন্য করেছি যে লালনপন্থীদের দয়া বা ক্ষমাসুলভ মনোভাব কেমন তা বোঝার জন্য)
দুর্লভ শাহ্: তারা তো কবেই শেষ হয়ে গেছে।
মেলায় যারা নিজেদের দাবী করে যে তারা লালনের ভক্ত, তা তাদের মনগড়া কথা, তারা ভাবে যে মনে মনে ভালোলাগে তাই ভক্ত হয়ে গেলাম। অন্তত ৩২ প্রকারের মাজারে মাজারে ঘোরা যাযাবর লোকজন ও ভ্রাম্যমান গাঁজা ব্যবসায়ীরা সেখানে যায়। আর যায় মধ্যবিত্ত তরুন- যুবারা।
বাউল আর শিল্পী এ দুটো যে আলাদা বিষয় তা ই তো বেশীরভাগ মানুষ জানেনা!
লালনের ভক্ত হতে হলে চারটি স্তর আছে- স্থুল, প্রবর্ত, সাধক, সিদ্ধ । ভক্ত হবার নিয়ম আছে, চাইলেই হওয়া যায়না। এই ভক্ত দাবীকারদের কয়জন সেসব জানে তা নিয়েই আমার সন্দেহ আছে। তবে হ্যা, আজকাল অনেকে টাকা পয়সা ঢেলেও গুরু বনে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের লাখো নেশাখোরের, মাদক ব্যবসায়ীর ও মোবাইল কোম্পানীর মেলার নামে মার্কেটিং দায়ী, দয়া করে লালন সাঁই এর উপর দেবেন না। এই রমরমা মাদক মেলা বন্ধ করতে চাইলে এই পাগলালিংক মেলা বন্ধ করে লালনের আখড়া প্রকৃত সাধুদের ফিরিয়ে দিতে হবে।
লেখাঃ সংগৃহীত