ক্যানোলা তেল না জেনে খাচ্ছেন না তো, জেনে নিন ক্যানোলা তেলের বিস্তারিত।
সুস্থ জীবনযাপনের প্রথম শর্ত স্বাস্থ্যকর খাবার। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রান্নার তেল। রান্নার তেলগুলোর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে সরিষা, সয়াবিন, পাম, ক্যানোলা, সানফ্লাওয়ার তেল, রাইস ব্র্যান তেল ইত্যাদি। গবেষণায় দেখা গেছে, এসব তেলের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘ক্যানোলা তেল’। বর্তমানে এটি বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদিত উদ্ভিজ্জ তেল।
১৯৭৪ সালে কানাডায় সর্বপ্রথম উৎপাদন করা হয় ক্যানোলা তেল। এই তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রধান হলো চীন, কানাডা, ভারত ও জাপান। ক্যানোলা তেলের রয়েছে বেশ কিছু উপকারী বৈশিষ্ট্য, যা স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুনঃ জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন দলের নাম
প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভোজ্য তেল হিসেবে সয়াবিন ও পাম অয়েল ব্যবহারের অভ্যাস বাংলাদেশিদের। তবে সম্প্রতি ক্যানোলা তেলকে এর একটা ভালো বিকল্প হিসেবে ভাবা হচ্ছে। আসলে ক্যানোলা তেল কেমন এবং এটি মানবদেহের জন্য কতটা উপকারী।
ক্যানোলা তেল কেমন
মূলত ক্যানোলা দেশের সরিষার মতই একটি ফসল। বলা যায় এটি কানাডার প্রধান একটি অর্থকরী ফসল। বিভিন্ন উৎসের হিসাবে দেখা গেছে, কানাডা প্রতি বছরে প্রায় ২০ মিলিয়ন টন ক্যানোলা উৎপাদন করে, যেখানে সয়াবিন উৎপাদন হয় মাত্র ৬ দশমিক ৫ টন।
ক্যানোলা তেলের রপ্তানির দিক থেকেও শীর্ষ দেশ কানাডা। দেশটি থেকে প্রতি বছরে প্রায় ২৯ লাখ মেট্রিক টন ক্যানোলা রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। এবং এক্ষেত্রে কানাডার প্রধান ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।কানাডা ছাড়াও ব্রিটেন, চীন ও পাকিস্তানসহ আরো অনেক জায়গায় উৎপাদিত হয় এই তেল।
এসব উপাত্তে সহজেই বোঝা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী তো ক্যানোলা তেলের চাহিদা আছেই কানাডায়ও এই ভোজ্য তেলটি জনপ্রিয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পর্যবেক্ষণ করা বিভিন্ন সাইট ঘেটে দেখা গেছে টন প্রতি ক্যানোলার আমদানি মূল্য প্রায় ৬৫৫ মার্কিন ডলার, যা সয়াবিনের চেয়ে বেশি।
ক্যানোলা তেলের পুষ্টিগুণ:
ক্যানোলা তেলের পুষ্টিগুণ অত্যন্ত ভালো স্বাস্থ্যকর একটি ভোজ্য তেল, যা মূলত ক্যানোলা উদ্ভিদের বীজ থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে। এটি রান্নার জন্য জনপ্রিয়, কারণ এতে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও নানা গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এক টেবিল চামচ বা প্রায় ১৪ গ্রাম খাবার উপযোগী ক্যানোলা তেলে পুষ্টিগুণ রয়েছে-
- ক্যালরি = ১২৪ ক্যালরি
- মোট ফ্যাট = ১৪ গ্রাম
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট = ১ গ্রাম
- মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট = ৮ গ্রাম
- পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট = ৪ গ্রাম
- ওমেগা-৩ফ্যাটি অ্যাসিড = ১.২ গ্রাম
- ওমেগা-৬ফ্যাটি অ্যাসিড = ২.৬ গ্রাম
- কোলেস্টরল = ০ মিগ্রাম
- ভিটামিন ই = ২.৪ মিগ্রাম (প্রায় ১৬% দৈনিক চাহিদা)
- ভিটামিন কে = ৮. ৬ মাইক্রোগ্রাম
ক্যানোলা কি সয়াবিনের চেয়ে স্বাস্থ্যকর
বেশির ভাগ বিশ্লেষকই সয়াবিনের চেয়ে ক্যানোলার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, ক্যানোলা অপেক্ষাকৃত ভারী, যা সহজে ভাঙে না। ক্যানোলা তেলে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাট বা চর্বি বহন করে, যা মানব শরীরের জন্য উপকারী। এসব উপাদানের উপস্থিতি সয়াবিন তেলে নেই।
ক্যানোলা তেলে ইউরিক এসিডের মাত্রা কম থাকার কারণেই নিরাপদ বলে বিবেচিত হয় না, বরং এতে খুব কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও উচ্চ মাত্রার পলিআনস্যাচুরেটেড ওমেগা-৩ ফ্যাট এবং ফাইটোস্টেরল থাকে, যা শরীরে কোলেস্টেরলের শোষণ কমায়।
আরও পড়ুনঃ পদ্মা সেতু হয়ে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা ট্রেন
ক্যানোলা তেলে তুলনামূলকভাবে উচ্চমাত্রার ট্রান্স-ফ্যাটি এসিড থাকার কারণে কিছু স্বাস্থ্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যা আখরোট তেলের সাথে তুলনীয়। কিন্তু সয়াবিন তেলের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ কম। ডিপ-ফ্যাট ফ্রাইয়ারে তেল ঘন ঘন পরিবর্তন না করলে ট্রান্স-ফ্যাটি এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তবে বেশিরভাগ বাড়িতে রান্নার পরিবেশে এটি স্কেলের নিচে থাকবে।
ক্যানোলা তেলের সুবিধা
ক্যান্সার প্রতিরোধে– ক্যানোলা তেলের জন্য ক্যান্সারের মতো রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি। কারণ এটি টিউমার সংকুচিত করে এবং কোষকে বাড়তে বাধা দেয়। ক্যান্সার রোগীরা যদি ক্যানোলা তেলের ব্যবহার নিয়মিত করার কথা ভাবেন তবে প্রথমে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডায়াবেটিসের জন্য– ডায়াবেটিক রোগীদের খাবারের বিশেষ যত্ন নিতে হয় এবং তারা কোন তেল ব্যবহার করছে, তাও জানা গুরুত্বপূর্ণ। সম্পূর্ণ কোলেস্টেরল ফ্রি হওয়ায় ক্যানোলা তেলও ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভালো বলে বিবেচিত হয়। কারণ এটি রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে।
ত্বকের জন্য– সবাই ত্বকের ভালো জন্য বিভিন্ন তেল ব্যবহার করেন। ক্যানোলা তেল ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে বিবেচিত হয়। এতে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের জন্য উপকারী। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে। বাইরে যাওয়ার আগে ত্বকে এই তেল লাগিয়ে বের হলে ত্বক ভালো থাকে।
চুলের জন্য– আজকাল মানুষের মধ্যে চুল পড়ার সমস্যা বাড়ছে। এর মূল কারণটি হল ভুল তেল নির্বাচন করা। তাই চুলে ক্যানোলা তেল ব্যবহার করুন। এতে ভালো পরিমাণে ভিটামিন ই রয়েছে, যা চুলের শিকড়কে শক্তিশালী করে। এ ছাড়া এটি চুল লম্বা করতে সহায়তা করে। সপ্তাহে দুবার চুলে তেল লাগালেই উপকার পাবেন।
প্রদাহ হ্রাস করতে– ক্যানোলা তেল চুলের জন্য উপকারী। তবে এতে প্রদাহ-হ্রাসকারী বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। কারণ ক্যানোলা তেলে ভিটামিন ই রয়েছে এবং এটি শরীরে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি হিসেবে কাজ করে। কিছু ক্ষেত্রে এটিকে বলা হয় ব্যথা উপশমকারী তেল। ক্যানোলা তেলের সাহায্যে আঘাতের কারণে ফোলাভাব ও ব্যথা হ্রাস করা যেতে পারে। কারণ এটিতে প্রদাহ বিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা প্রদাহ হ্রাস করতে সহায়তা করে।
হার্টের জন্য— অন্যান্য রান্নার তেলের তুলনায় ক্যানোলা তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে কম। মাত্র ৭ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকার কারণে এই তেল হার্টের জন্য ভালো। ৬৪ শতাংশ মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড থাকায় এটি পেটের মেদ কমাতেও কার্যকর। হাই স্মোক পয়েন্টের কারণে এই তেল ভাজাপোড়ার জন্যও ভালো। খাবারকে মচমচে করে ভাজার জন্য এই তেলের জুড়ি নেই।
অন্যান্য রান্নার তেল খাবারের স্বাদ পরিবর্তন করে ফেলে কিন্তু ক্যানোলা তেলে খাবারের স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। বিশ্বব্যাপী ক্যানোলা তেলের জনপ্রিয়তার এটি একটি অন্যতম কারণ।
ক্যানোলা তেলের অসুবিধা
ক্যানোলা তেলের উপকারিতা অনেক। তবে অতিরিক্ত ব্যবহারের কিছু ক্ষতিকারক পরিণতি হতে পারে।
ক্যানোলা তেলের অতিরিক্ত ব্যবহার হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই স্বল্প পরিমাণে এই তেলটি ব্যবহার করুন। কিছু গবেষণার তথ্য মতে, ক্যানোলা তেল মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া মস্তিষ্ককে দুর্বল করে তোলে, স্মৃতি শক্তি হ্রাস করে।
এই তেল কিডনি ও লিভারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কারণ এই তেলটি বায়োটেকনোলজি প্রক্রিয়া থেকে তৈরি হয়। কারো কারো মতে, ক্যানোলা তেলে কোনো বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে। এই তেলটি সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বকের সমস্যা হতে পারে। এই তেলটি ব্যবহার করার আগে আপনার চিকিৎসকের মতামত নেওয়া উচিত।
আপনি যদি ক্যানোলা তেল ব্যবহার করে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম অনুভব করেন, তবে এর ব্যবহার কমিয়ে দিন এবং নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।