✡️ পিতৃতান্ত্রিক ধারার সূচনা
ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম—এই তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের মূল ভিত্তিতে রয়েছেন হযরত ইবরাহিম (আঃ)। ইবরাহিম (আঃ) এর দুই পুত্র: ইসহাক (আঃ) ও ইসমাইল (আঃ)। ইসহাক (আঃ) এর পুত্র হযরত ইয়াকুব (আঃ), যিনি ইস্রাইল নামেও পরিচিত। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বংশধরদের ‘বনি ইসরাইল’ নামে অভিহিত করেন। ইয়াকুব (আঃ) এর ১২ পুত্রের মধ্যে ইয়াহুদা ছিলেন অন্যতম, যার নামানুসারে "ইহুদি" শব্দের উৎপত্তি।
আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যে ইহুদি ধর্ম অন্যতম প্রাচীন। এই ধর্মের অনুসারীরা নিজেদের "বনি ইসরায়েল" বা "ইসরায়েলের সন্তান" হিসেবে পরিচয় দেয়, যা নবী ইয়াকুব (আঃ)-এর আরেক নাম "ইসরায়েল" থেকে উদ্ভূত। তাদের ইতিহাস, বিশ্বাস এবং ভূমির সাথে তাদের সম্পর্ক ফিলিস্তিন সংঘাতের কেন্দ্রে রয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা ইহুদি ধর্ম ও জাতির ঐতিহাসিক বিবর্তন, ফিলিস্তিনের সাথে তাদের সম্পর্ক এবং আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
আরও পড়ুনঃ জমজম কূপের রহস্য
ইসলাম ও ইহুদি উভয় ধর্মেই হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে জাতির পিতা হিসেবে সম্মান করা হয়। তাঁর দুই পুত্র ছিলেন ইসহাক (আঃ) এবং ইসমাঈল (আঃ)। হযরত ইসহাক (আঃ)-এর পুত্র ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আঃ), যিনি ইসরায়েল নামেও পরিচিত। ইয়াকুব (আঃ)-এর বংশধরদেরই বনি-ইসরায়েল বলা হয়। ইয়াকুব (আঃ)-এর ১২ সন্তানের মধ্যে একজন ছিলেন ইয়াহুদা, যার বংশধররা পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে। এই ইয়াহুদার বংশ থেকেই "ইহুদি" নামের উৎপত্তি। এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ইহুদি ধর্ম এবং ইহুদি বংশ দুটি ভিন্ন ধারণা। যদিও বেশিরভাগ ইহুদি বংশের লোক ইহুদি ধর্মের অনুসারী, তবে সব ইহুদি ধর্মের অনুসারীই ইয়াহুদার বংশের নন।
প্রায় ৪ হাজার বছর আগে, ইসহাক (আঃ)-এর মৃত্যুর পর ইয়াকুব (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে শামনগরী (সিরিয়া) থেকে কেনানে (বর্তমান ফিলিস্তিন) হিজরত করেন। পরবর্তীতে কেনানে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ইয়াহুদা তার ভাইদের সাথে মিশরে চলে যান এবং সেখানে বসবাস শুরু করেন। মিশরের তৎকালীন শাসক ছিলেন ইয়াকুব (আঃ)-এর ১১তম পুত্র ইউসুফ (আঃ)। ফলে ইয়াহুদা ও তার বংশ মিশরে বেশ দাপটের সাথেই বসবাস করতে থাকে।
তবে, কালের পরিক্রমায় মিশরের ক্ষমতা ফারাও রাজাদের হাতে চলে আসে। ফারাওরা বনি-ইসরায়েলদের উপর অকথ্য নির্যাতন শুরু করে। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা তাদের মুক্তির জন্য হযরত মূসা (আঃ) এবং তাওরাত কিতাব পাঠান। মূসা (আঃ) ফেরাউনকে নীলনদে ডুবিয়ে বনি-ইসরায়েলদের মুক্তি এনে দেন। এরপর মূসা (আঃ) তাদের নিয়ে কেনানে (ফিলিস্তিন) ফিরে যান। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত পাওয়ার পরেও মূসা (আঃ)-এর ওফাতের পর তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে গো-পূজাসহ নানা অনাচারে লিপ্ত হয়। ক্ষমতার লোভে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এবং ভিনদেশীরা তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আবারও তাদের দাসত্বে আবদ্ধ করে।
প্রায় ১০০ বছর পর, হযরত দাউদ (আঃ) এবং তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আবারও বনি-ইসরায়েলদের এই অত্যাচার থেকে মুক্তি দেন। কিন্তু সুলাইমান (আঃ)-এর মৃত্যুর পর ইহুদিরা আবারও শয়তানের পূজা শুরু করে। তাদের মধ্যে থাকা কিছু ধর্মব্যবসায়ী তাওরাত কিতাবের মধ্যে নিজেদের সুবিধামতো সংযোজন-বিয়োজন করার মতো ধৃষ্টতা দেখায়। তারা তাওরাতে সংযোজন করে যে, "আল্লাহ তায়ালা ইসহাক (আঃ)-এর স্বপ্নে কেনানকে ইহুদিদের জন্য 'প্রমিজ ল্যান্ড বা প্রতিশ্রুত ভূমি' হিসেবে দিয়েছেন, এটা তাদের জয় করে নিতে হবে।" ইহুদিরা এটাকে 'জেকব লেডার ড্রিম' বলে থাকে।
তাদের এমন নির্লজ্জতা ও ধৃষ্টতার কারণে ইহুদিরা বারবার আল্লাহর শাস্তির মুখে পড়েছে। কখনো গৃহহীন যাযাবরের মতো ঘুরেছে, কখনো ব্যবিলনীয় সাম্রাজ্যের দ্বারা গণহত্যা শিকার হয়েছে, আবার কখনো রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা সিরিয়া থেকে আরব দেশে বিতাড়িত হয়েছে। মহানবী (সাঃ)-এর সময় তারা আরব দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপে চলে যায়। উমার (রাঃ) ফিলিস্তিন ও আল-আকসা বিজয় করেন।
বনি-ইসরায়েলের এমন পরিণতির কারণ আল্লাহর শাস্তি এবং তাদের নিজস্ব আচরণ। তৎকালীন লোকদের ভাষ্যমতে, তারা অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ ছিল। তাদেরকে যেখানে আশ্রয় দেওয়া হতো, সেখানেই তারা তাদের প্রতিবেশীর জমি দখল করতো। ইহুদিরা বেশিরভাগই ব্যবসায়ী ছিল এবং তাদের ব্যবসা অন্যদের থেকে কৌশলগতভাবে আলাদা ছিল, যার কারণে যাযাবরের মতো ঘুরলেও তাদের অর্থ-সম্পদ ভালোই ছিল। সেই অর্থ-সম্পদের দাপট দেখিয়ে তারা সেইসব এলাকার স্থানীয় লোকদের উপর ছড়ি ঘোরাতো। তাই তারা সেইসব এলাকার রাজা ও বাসিন্দাদের দ্বারা বারবার বিতাড়িত হতো।
বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করার পর তারা একসময় বুঝতে পারে যে, যেকোনো সমাজকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে শিক্ষা ও অর্থের বিকল্প নেই। তাই তারা শিক্ষা অর্জন ও অর্থ উপার্জনের উপর গুরুত্ব দেয়। তারা বিশ্বাস করে, কেনান তাদের জন্য সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক বরাদ্দকৃত ভূমি এবং একদিন তাদের একজন মেসিয়াহ (দাজ্জাল) এসে তাদের এই ভূমিকে উদ্ধার করে দেবে।
১৮শ শতাব্দীতে ইহুদিরা তাদের ধর্ম-পরিচয় গোপন করে ইউরোপে বসবাস শুরু করে। তখন থিওডোর হার্জেল নামে তাদেরই একজন ব্যবসায়ী ফিলিস্তিনকে নিজেদের দখলে আনার লক্ষ্যে ১৮৯৭ সালে জিওনিজম আন্দোলন শুরু করেন এবং ইহুদিদেরকে আবারও নতুন করে স্বপ্ন দেখানো শুরু করেন। যারা এই আন্দোলনকে সমর্থন করে, তাদের জিওনিস্ট বলা হয়।
ইহুদিরা অনেক শিক্ষা অর্জন ও অর্থ উপার্জন করায় তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মানুষ ইউরোপে ধর্ম গোপন করে থাকলেও কেউ কেউ মেধার জোরে ইউরোপে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করতে, বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। তখন তারা শুধুমাত্র পদ দখল করেই থেমে থাকেনি, সেই সাথে নিজেদের একটি রাষ্ট্র গঠনেও প্রচুর সমর্থন সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে থাকে। তখন ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো, তাদেরকে আফ্রিকার উগান্ডায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
ঠিক এমন সময় শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে যুক্তরাজ্য নিজেদের অস্ত্র সংরক্ষণের জন্য এক ধরনের গ্লিসারিন ব্যবহার করতো, যা আসতো জার্মানি থেকে। কিন্তু যুদ্ধের সময় জার্মানি যুক্তরাজ্যের বিপক্ষে থাকায় গ্লিসারিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। তখন যুক্তরাজ্যকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন চাইম ওয়াইজম্যান নামক একজন ইহুদি গবেষক ও ব্যবসায়ী। তিনি গ্লিসারিনের বদলে অ্যাসিটোন দিয়ে অস্ত্র সংরক্ষণের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন এবং যুদ্ধে প্রচুর অর্থ সহায়তা দেন।
তার এমন অভূতপূর্ব অবদানের জন্য যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য যখন তাকে পুরস্কৃত করতে চায়, তখন তিনি জানান যে তার একমাত্র পুরস্কার হবে তাদের প্রমিজ ল্যান্ড বা প্রতিশ্রুত ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তিনে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দেওয়া। এখানে উল্লেখ্য, চাইম ওয়াইজম্যান ছিলেন জিওনিজম আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
ফিলিস্তিন তখন ছিল উসমানী সালতানাতের দখলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর তুরস্কের ক্ষমতা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। সেই সুযোগে ধাপে ধাপে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে থাকে। প্রথমে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করে, তারপর বেশি দামের লোভ দেখিয়ে সেগুলো কিনতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজয়ের পর পুরো বিশ্বের ক্ষমতা ইউরোপের হাতে চলে যায়। ইহুদিরা তখন স্থানীয় ফিলিস্তিনিদেরকে অত্যাচার-জোর-জবরদস্তি করা শুরু করলে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবাদ করে। তখনই ইউরোপ থেকে ঘোষণা আসে, পুরো ফিলিস্তিনের ৫৫ ভাগ থাকবে ফিলিস্তিনিদের দখলে আর বাকি ৪৫ ভাগ হবে ইহুদিদের। প্রায় ৬ লাখ ইহুদীর জন্য ৪৫% এবং প্রায় ১২ কোটি ফিলিস্তিনির জন্য ৫৫% জায়গা!
জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। নবগঠিত এই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন চাইম ওয়াইজম্যান। ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন হওয়ার ঠিক ৬ মিনিটের মধ্যে আমেরিকা তাদের স্বীকৃতি দেয়! এভাবেই যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে তারা ইয়াকুব (আঃ)-এর সাথে কেনানে আসা যাযাবর থেকে আজকে গাজাকে ধ্বংসকারী দানবে পরিণত হয়েছে।
ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ইহুদিরা ইউরোপ ও আমেরিকার সমর্থনে ফিলিস্তিনিদের জমি দখল, বাস্তুচ্যুতি এবং সহিংসতার পথ বেছে নেয়। আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্র সেই যাযাবর বনি ইসরাইলদের রূপান্তর, যারা ইতিহাসের নানা সময়ে নিপীড়িত ছিল, আর আজ নিজেরাই নিপীড়ক।
এই দীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস আমাদের ফিলিস্তিন সংঘাতের গভীরতা অনুধাবনে সাহায্য করে। ইহুদি জাতির ধর্মীয় বিশ্বাস, ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক রাজনৈতিক লক্ষ্য কীভাবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে, তা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট | ইসরায়েল প্যালেস্টাইন সংকট |
দিনবার্তা | সব সময়, সব খানে
এই সাইটে নিজম্ব নিউজ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন নিউজ সাইট থেকে খবর সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ প্রকাশ করে থাকি।
কোন খবর নিয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট নিউজ সাইটের কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করার অনুরোধ রইলো।
Copyright © 2025 DinBarta. All rights reserved.