গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক ছাপাখানা ‘এম এন প্রেস’ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে চুক্তি সই সম্পন্ন হয়েছে।
ভারত উপমহাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ কাঙ্গাল হরিনাথের মাসিক পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘। বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের হিসাব করলে এটি থাকবে প্রথমের দিকে।
১৮৬৩ সালের এপ্রিলে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে যখন গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বের করা হয়, উপমহাদেশের প্রথম ‘আধুনিক সংবাদপত্র’ প্রকাশের সময়কাল তখন সবে ৮৩ বছর। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা আরেকটি জায়গায় অন্য সংবাদপত্র থেকে আলাদা।
উপমহাদেশের প্রথম দিকের অধিকাংশ পত্রিকাই ছাপা হতো বড় শহর থেকে। গ্রামবার্তা প্রকাশিকা ১৮৬৪ সাল থেকেই কুমারখালীতে স্থাপিত ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়। গ্রামীণ এলাকা থেকে এমন মুদ্রিত সংবাদপত্রের সংখ্যা সব বিচারেই নগণ্য ছিল সেই সময়।
আর্থিক সংকট ও ব্রিটিশদের নিবর্তনমূলক আইনের কারণে ১৮ বছর পর বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক সেই ছাপাখানা এত দিন সংরক্ষিত ছিল কাঙ্গাল হরিনাথের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।
নানা জটিলতায় এটি জাদুঘরে নেওয়া যায়নি। অবশেষে সেই ছাপাখানাটি নেওয়া হচ্ছে ২০১৭ সালে কুমারখালীতে প্রতিষ্ঠিত কাঙ্গাল হরিনাথের স্মৃতি জাদুঘরে।
গত শনিবার জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ছাপাখানাটি হস্তান্তরের একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। স্বার্থের বিনিময়ে স্বত্ব হস্তান্তর চুক্তিপত্রে সই করেছেন কাঙ্গাল হরিনাথের চতুর্থ বংশধরের স্ত্রী শ্রীমতী গীতা মজুমদার ও জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো: কামরুজ্জামান। ছাপাখানাটি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাঙ্গাল হরিনাথের বাস্তুভিটা থেকে স্মৃতি জাদুঘরে নেওয়া হবে।
জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো: কামরুজ্জামান জানান, শনিবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে চুক্তিনামা অনুষ্ঠানটি হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় জাদুঘর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
চুক্তিতে প্রথম সাক্ষী কাঙ্গাল হরিনাথের পঞ্চম বংশধর দীপঙ্কর মজুমদার জানান, ২০ লাখ টাকার চেক এবং পরিবারের দু’জনের চাকরির বিনিময়ে তাঁর মা প্রেসটি হস্তান্তরের চুক্তিনামায় সই করেছেন। তারা চেক হাতে পেয়েছেন। চুক্তি করতে পেরে তারা খুশি।
আরও পড়ুনঃ কুষ্টিয়া থেকে ট্রেনের সময়সূচী
চুক্তিনামার দ্বিতীয় সাক্ষী সাংবাদিক কে এম আর শাহীন জানান, পরিবার ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতায় দীর্ঘদিন ধরে চুক্তির বিষয়টি ঝুলে ছিল। ঐতিহাসিক এ চুক্তির অংশ হতে পেরে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন।
কাঙ্গাল হরিনাথ ১৮৩৩ সালের ২২ জুলাই তৎকালীন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার হলেও কাঙ্গাল হরিনাথ নামেই পরিচিত। তিনি সংবাদপত্রে দারিদ্র্য ও নাগরিক সচেতনতা বিষয়ে লেখালিখি করতেন।
প্রথম দিকে তিনি কবি ঈশ্বরচন্দ্রের ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ নিজ গ্রামের মানুষের ওপর নির্যাতন ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন।
পরে নিজ উদ্যোগে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা বের করেন। প্রথমে এটি মাসিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করা হলেও পত্রিকাটি কালক্রমে প্রথমে পাক্ষিক ও সবশেষে এক পয়সা মূল্যমানের সাপ্তাহিকীতে রূপান্তরিত হয়।
এতে সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান বিষয়ে প্রবন্ধ ছাপা হতো। এ ছাড়া ব্রিটিশ নীলকরদের শোষণের বিভিন্ন ঘটনাও ছাপা হতো।
১৮ বছর রাজশাহীর রানী স্বর্ণকুমারী দেবীর সহায়তায় এটি চালানোর পর আর্থিক সংকট এবং সরকারের নিবর্তনমূলক আইনের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়।
এর পর থেকে কাঙ্গাল হরিনাথের বাস্তুভিটায় জরাজীর্ণ ভবনে ছাপাখানাটি রাখা ছিল। এ বিষয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী গীতা মজুমদার বলেন, কাঙ্গাল হরিনাথ মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু তাঁর বংশধররা এখনও অবহেলিত। তারা কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাননি। কাঙ্গাল হরিনাথের জন্য কোনো দিবসও পালন হয় না। এসব বিষয়ে তাদের বিভিন্ন দাবি পূরণ না হওয়ায় এত দিন ছাপাখানাটি হস্তান্তর আটকে ছিল।
কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘরের অনুসন্ধান কর্মকর্তা ওবাইদুল্লাহ জানান, ২০১৭ সালে স্মৃতি জাদুঘরটি চালু হলেও ছাপাখানাটি রয়েছে হরিনাথের বাস্তুভিটায়। দর্শনার্থীরা এসেই আগে প্রেসটি দেখতে চান। জটিলতার অবসান ঘটিয়ে ঐতিহাসিক স্বত্বটি পাচ্ছেন তারা।